Thursday, August 6, 2009

হূদয় ভালো তো হূদরোগ বিদায়

এস কে অপু
হূদরোগ বিশেষজ্ঞ
ময়মনসিংহ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়

হার্ট অ্যাটাক হচ্ছেই। এ হচ্ছে নেতিবাচক প্রভাব। রাত-দিন খাটছে, সৎ থাকছে। তবু নিগৃহীত। জীবনযুদ্ধে নেই পুরস্কার। পদোন্নতি নেই। বসাচ্ছে এনে অযোগ্য লোক। এ যেন মানসিক যন্ত্রণা আর নিগ্রহ। বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ, ঘটছে হার্ট অ্যাটাক। কাজপাগল, ওপরে ওঠার জন্য খুব আগ্রহী কিংবা সারাক্ষণ প্রতিযোগিতা করতে চাওয়া বা আক্রমণাত্মক, তিরিক্ষি মেজাজের লোকেরাই ‘টাইপ-এ’ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হন। আজকাল এসব লোকের চেয়ে সুশীল সমাজে বেড়ে যাচ্ছে হার্ট অ্যাটাক। দেখা যাচ্ছে, যাদের জীবন চলছে দ্রুতগতিতে−ব্যস্ততায়, প্রতিযোগিতায় বা দ্রুত কথা বলে, তারা হূদয়টাকে রাখে সজীবতায়। ‘টাইপ-এ’ লোকের হূদরোগও কমে গেছে।

চাপ মোকাবিলা করুন দৃঢ়ভাবে
থাকুক না জীবনের চাপ। থাকুক লড়াই। যদি থাকে সমাজে পুরস্কার−হয় না হূদয় আহত। সৎ ও যোগ্যের প্রশংসা, ভালো কাজের পুরস্কার হলে, হার্ট হয়ে ওঠে সজীব-সতেজ। আজকাল গবেষণায় নতুন সুর−কোনো ব্যক্তির আবেগের নেতিবাচক দিক কিংবা ব্যক্তিত্বের নেতিবাচক দিকের কারণে হূদয় অকালেই ভেঙে পড়ছে। মৃত্যুও হচ্ছে। তাই চাপ মোকাবিলা করতে হবে দৃঢ়ভাবে।

দূরে ঠেলুন বিষণ্নতা
‘বিষণ্নতা’ মনকে করে কাবু। এতে হার্ট অ্যাটাক অতি দ্রুত ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বিষণ্ন মনের লোক তাদের হার্ট অ্যাটাকে, বিষণ্ন নয় এমন রোগীর তুলনায় চার গুণ বেশি ঝুঁকি। সুতরাং হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের চাই মনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। যদি বিষণ্ন মনে থাকে সারাক্ষণ, এসব রোগী কয়েক বছরের মধ্যেই আবার হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। বিষণ্ন মানুষ বদভ্যাসে জড়িয়ে পড়ে। ধূমপান বা মদ্যপান করে। সুষম খাবার খায় না। ব্যায়াম করে না। মন কেবলই উথালপাথাল। মনের ভেতর সব সময় নেতিবাচক প্রশ্ন। মন হয় ক্ষতবিক্ষত।

প্রফুল্ল থাকুন মন
বিষণ্ন ও ভগ্নমন থেকেই বাড়ে হূৎস্পন্দন। বেড়ে যায় স্ট্রেস হরমোনের মান। হূদ-ছন্দের ওঠানামা হয় অসংগতিপূর্ণ। রক্তের জমাটবাঁধা প্রক্রিয়া বেড়ে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। রক্তনালির পথ বন্ধ হয়ে ঘটায় হার্ট অ্যাটাক। বিষণ্ন মনের লোকদেরই রক্তনালিতে মন্দ কোলেস্টেরল বেশি জমে। তাই প্রফুল্ল মন নিয়ে থাকা ভালো।

ঝেড়ে ফেলুন দুশ্চিন্তা
দুশ্চিন্তা বেশি হলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়বেই। অযথা দুশ্চিন্তার কোনো মানেই হয় না। এই চাপ আর দুশ্চিন্তায় বেড়ে যায় অ্যাড্রেনালিন হরমোন। অন্যান্য হরমোনও। বেড়ে যায় হূৎস্পন্দন। রক্তচাপ বাড়ে। রক্তে বাড়ে চর্বিকণা। যতবার বাড়ে রক্তচাপ, ততই হার্টের রক্ত ধমনির গায়ে পড়ে চর্বির আস্তরণ। হার্টের মাংসপেশিতে হয় রক্তের অভাব। তৈরি হয় কোলেস্টেরল। জমে ধমনির গায়ে। হার্টের রক্তনালি বন্ধ। ঘটে হার্ট অ্যাটাক। তাই দুশ্চিন্তা কমিয়ে ফেলুন। সম্ভব হলে একদম নয়।

রাগ নয় একদম
রাগ হূদ্যন্ত্রের মারাত্মক শত্রু। অল্পস্বল্প রাগ করুন। কিংবা রাগ পুষে না রেখে সরাসরি প্রকাশ করুন। ভালো। কিন্তু প্রচণ্ড রাগ শুধু হার্টকেই নাড়া দেয় না, রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াতেও প্রভাব ফেলে। রক্তনালিগুলো সংকুচিত হয়। দেহে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। এমনকি মস্তিষ্কের, হূৎপিণ্ডে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। হঠাৎ রেগে দেখুন। শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যাবে। হার্টবিট বেড়ে যাবে। রক্তচাপ বাড়বে। চোখের মণি বড় হবে। সঙ্গে রক্তে শর্করা বেড়ে যাবে। হজম কমে যাবে। অন্যান্য অঙ্গের রক্ত চলে আসে রক্তনালি দিয়েই কেন্দ্রীয় স্মায়ু, পেশি ও হার্টে। মস্তিস্ক থেকে সংকেত দেবে হরমোন নিঃসরণে। নাম ‘নর-অ্যাড্রেনালিন’। রক্তে বেড়ে যাবে চর্বি থেকে ফ্যাটি এসিড। রক্তনালির গায়ে আস্তরণ ফেলে ধমনির পথ সরু হবে। রক্ত জমাট বেঁধেই ঘটে অক্সিজেনের অভাব। এরপর হার্ট অ্যাটাক। তাই রাগ ভালো না। রাগ আর দুশ্চিন্তা মিলে হূদয়ের ছন্দে ঘটে অনিয়ম। সৃষ্টি হয় নেতিবাচক আবেগ। তাই আবেগগুলো দমন করতেই হবে বা সংযত করতে হবে। বিশেষজ্ঞের মতে, যেসব আবেগ হূদরোগের সঙ্গে জড়িত, তা দূর করা যায় অন্যান্য মানুষের সঙ্গে কথা বলে, হাসিখুশিতে। প্রয়োজনে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে। কথা বলুন মন খুলে। বিশ্বাস করুন সহজে। দেখবেন আপনার জীবনসঙ্গী হূদয় খুলে দেবে অকাতরে। তা না হলে হূদয়ে ঘটবে তোলপাড়। ততই ধরা পড়বে হার্টের পাগলামি। কখনো দেখবেন, কিছু হূদরোগী বা হূদরোগপ্রবণ লোক হাসেও না, কাঁদেও না। কেমন জানি মুখ ভার। যেন ‘ক্লেশগ্রস্ত মানুষ’। কোনো ধরনের আবেদন সহ্য হয় না। হাসে না। যেন হাসতে তাদের মানা। সারাক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে থাকে। কাজেকর্মে সারাক্ষণ অভিযোগ। রাগ রাগ ভাব। যেন নিরাপত্তার অভাব। তাতে স্ট্রেস হরমোন বেড়েই চলে। এই দুশ্চিন্তা, পীড়ন, নানা বিপত্তি, আবেগ আটকে রাখা সবই বাড়িয়ে দেয় রক্তচাপ। যদি প্রতিদিন এসব ঘটতেই থাকে, হয়ে ওঠে ক্ষতিকর।

আন্তরিক হোন যথেষ্ট
যতই থাকুক হূদরোগের ঝুঁকি, সহজ পথেই তা দূর করা যায় বা হওয়ার আগেই রোধ করা যায়। বাড়িয়ে দিন সাহায্যের হাত। কাজ করুন মানুষের জন্য। প্রয়োজনে কোনো প্রতিষ্ঠানে। মিশে যান শিশুদের মধ্যে। খোলামেলা কথা বলুন। নিঃসঙ্গ আত্মীয়ের সঙ্গে সময় কাটান কথা বলে। ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে নিয়ে বসে বই থেকে পড়ান, গল্প বলুন। এতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। হূদয় সতেজ হবে। যদি চাকরি থেকে অবসর নেন, বেড়ে যায় আরও মানসিক চাহিদা। ফুরফুরে মন নিয়ে বাগান করুন। নতুন ভাষা শিখুন। কম্পিউটারে হাত দিন। স্মৃতিচারণা করুন, আত্মকথা লিখুন। বিকেলে বেড়াতে যান। একটু শরীরচর্চাও ভালো। সবার সঙ্গে মজা করে কথা বলুন। হাসুন। বন্ধুদের সঙ্গে খেলুন, পিকনিকে যান। মেলা থেকে ঘুরে আসুন। বেশি করে মেলামেশা করুন। আরও আনন্দ পাবেন। কথা বলবেন খোলা আকাশের মতো। আবার অন্যের কথাও শুনবেন কিন্তু বিরক্ত না হয়ে, দাঁতে দাঁত না চেপে। শুনুন হেসে হেসে। যদি মনে দানা বাঁধতে চায় রাগ, শত্রুতা, বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা−ভেঙে গুঁড়িয়ে দিন মন থেকে। জীবনে একা না থেকে সময়ে বেছে নিন ভালো জীবনসঙ্গী। সে হবে আপনার প্রকৃত বন্ধু। একসময় ঘরে আসবে নতুন শিশু। যারা হবে জীবনের আরেক শক্তি, হবে অবলম্বন। সবাইকে নিয়েই বাঁচতে শিখতে হবে। মনটাকে সারাক্ষণ রাখুন খোলা আকাশের মতো। দেখবেন হূদরোগের ঝুঁকি কমে হূদয় ভরে যাবে ফুলের সৌরভে।

সূত্রঃ প্রথম আলো- জুলাই, ২০০৯

0 comments: