Friday, August 7, 2009

সর্পদংশন বিষয়ে প্রথম জাতীয় জরিপ

৮৬ শতাংশ মানুষ ওঝার কাছে যায়। চিকিৎসকেরকাছে যায় ৩ শতাংশ। আক্রান্ত বরিশালে বেশি, সিলেটে কম। বছরে বিশ্বে আক্রান্ত ৩০ লাখ, মারা যায় দেড় লাখ
বছরে প্রায় ৬ লাখ মানুষ সাপের কামড় খায়, মারা যায় ৬০৪১
শরিফুজ্বামান, প্রথম আলো

সাপে কামড়ানোর পর ৮৬ শতাংশ মানুষ ওঝার কাছে যায়। চিকিৎসকের কাছে যায় মাত্র তিন শতাংশ। বাংলাদেশে সাপের কামড় এবং এর ঝুঁকি নিরূপণ বিষয়ে এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষকেরা বলছেন, এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে এটাই প্রথম জরিপ।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের গ্রামে বছরে প্রতি এক লাখের মধ্যে ৬২৩ জন সাপের কামড়ের শিকার হয়। এই হিসাবে গ্রামে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৯ জন সাপের কামড়ের শিকার হয়। এদের মধ্যে বছরে মারা যায় ছয় হাজার ৪১ জন। সারা বিশ্বে এই সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি।
গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপ আছে। এর মধ্যে বিষধর সাপ রয়েছে ২২ প্রজাতির। তাঁরা সাপের কামড়কে বাংলাদেশের প্রাচীন ও অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন। এ সম্পর্কে জাতীয় ধারণা তৈরির জন্য তাঁরা এ ধরনের গবেষণায় সম্পৃক্ত হয়েছেন বলে জানান।
দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রচলিত পুরোনো তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর ৮-১০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। এদের মধ্যে মারা যায় হাজার দুয়েক। বাংলাদেশে প্রতি লাখে ৪ দশমিক ৩ জন সাপের কামড়ের শিকার হয় বলে এত দিন তথ্য ছিল।
এই গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিশ্বব্যাংক ও অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসেল ইউনিভার্সিটি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক রিদওয়ানউর রহমান ও অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসেল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আবুল হাসনাৎ মিল্টন গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। তাঁদের সঙ্গে আরও আছেন নিউ ক্যাসেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এলিসন জনস ও অধ্যাপক ক্যাথারিন ডেসটি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এম এ ফয়েজ প্রমুখ।
হাঁটার সময় সাপে কামড়ায় বেশি: গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁটার সময় সাপের কামড়ের ঘটনা বেশি ঘটে এবং গ্রামাঞ্চলে মোট আক্রান্তের ২৭ শতাংশ এভাবে চলার পথে দংশিত হয়। এ ছাড়া পানিতেও দংশিত হয় ২৭ শতাংশ মানুষ।
এ প্রসঙ্গে আবুল হাসনাৎ বলেন, গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে রাতের বেলায় হাঁটার সময় সাপে কামড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে। এ ছাড়া ঘুমের মধ্যেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে।
বরিশালে বেশি, সিলেটে কম: দেশের ছয়টি বিভাগের মধ্যে বরিশালে সাপে কামড়ানোর ঘটনা বেশি। ওই বিভাগে বছরে প্রতি লাখে দুই হাজার ৬৬৭ জন দংশিত হয়। এই সংখ্যা খুলনা বিভাগে প্রতি লাখে ৯৩৬ জন। নদীবহুল ও উপকূলীয় অঞ্চলে সাপের প্রকোপও বেশি।
চট্টগ্রাম বিভাগে সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয় ৩৯৭ জন। পাহাড়ি এলাকা হলেও ওই অঞ্চলে সাপে কামড়ানো এবং মৃত্যুর ঘটনা তুলনামূলক কম পাওয়া গেছে। এর কারণ হিসেবে একজন গবেষক বলেছেন, সাপের উপদ্রব সম্পর্কে ওই এলাকার মানুষ বেশি সচেতন এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ বিষয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় ওঝাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস প্রতিষ্ঠার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে এবং সেখানে সাপে কামড়ানোসহ এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। রাজশাহী বিভাগে প্রতি লাখে ৪৭২ জন এবং ঢাকা বিভাগে প্রতি লাখে ৪৪০ জন সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়।
ওঝাই ভরসা: গবেষণা অনুযায়ী, সাপে কামড়ানোর পর ৬০ শতাংশ মানুষ বা তাদের আত্মীয়স্বজন দোয়া-দরুদ ও মন্ত্র পাঠ করে। ৭৫ শতাংশ দুই ঘণ্টার মধ্যে কোনো না কোনো ধরনের চিকিৎসা নেয়। বিশেষ করে ওঝার কাছে যায়।
এ প্রসঙ্গে রিদওয়ানউর রহমান বলেন, ওঝাদের প্রশিক্ষণ দিলে সাপে কামড়ানো রোগীকে ছয় থেকে ১২ ঘণ্টা টিকিয়ে রাখা যায়। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে যাওয়ার আগেই সাপে কামড়ানো অর্ধেক রোগী মারা যায়। এ জন্য ওঝাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে এবং কমিউনিটি হাসপাতালে এর চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে সাপের কামড়ে প্রাণহানির ঘটনা কমে আসবে।
সাপে কামড়ালেই মৃত্যু নয়: গবেষণায় বলা হয়েছে, সাপে কামড়ানোর পর ৬০ শতাংশ রোগী মনে করে যে বিষধর সাপই তাদের কামড় দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সাপে কামড়ানো ৯০ শতাংশের বেশি রোগী বেঁচে যায়।
রিদওয়ানউর রহমান বলেন, অধিকাংশ সাপই বিষধর নয়। বিষধর সাপ কামড়ালেও পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া গেলে রোগী বেঁচে যায়। বিষধর সাপ কামড় দিলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, মরার মতো হয়ে থাকে। কিন্তু মারা যায় কয়েক ঘণ্টা পর। তিনি আরও বলেন, গোখরা, দুমুখো সাপ, গাছে থাকা সাপসহ কয়েকটি প্রজাতির সাপের কামড়ে মৃত্যু ঘটে।
বিশ্বে মারা যায় দেড় লাখ: প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় দেড় লাখ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। আর সাপ কামড় দেয় প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে। আক্রান্ত ও মারা যাওয়া মানুষের প্রায় সবাই দরিদ্র এবং গ্রামের অধিবাসী।
গবেষকেরা বলেছেন, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলের মতো উন্নত কিছু দেশে সাপের প্রকোপ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও নেপালে সাপের প্রকোপ বেশি। তবে নেপালের গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের সাদৃশ্য রয়েছে। নেপালে প্রতি লাখে সাপের কামড়ের শিকার হয় এক হাজার ১৩০ জন।
অধ্যাপক এম এ ফয়েজ বলেন, সাপের কামড় হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবহেলিত স্বাস্থ্য সমস্যা। এটা মূলত গ্রামের দরিদ্র মানুষের সমস্যা। এর চিকিৎসা, ওষুধ, প্রশিক্ষণ, প্রতিকারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করেন।
রিদওয়ানউর রহমান বলেন, সারা বিশ্বে এমনকি বাংলাদেশে সাপের কামড় সম্পর্কে যে পরিসংখ্যান রয়েছে, তা বাস্তবের তুলনায় অনেক কম। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ধনী দেশ, বিত্তবান বা শহরের মানুষ সাপের কামড়ে সাধারণত আক্রান্ত হয় না। সংক্রামক রোগ না হওয়ার কারণে সাপে কামড়ানোর বিষয়টি উন্নত বিশ্বের নজরে আসছে না।
আবুল হাসনাৎ বলেন, পৃথিবীতে বিষক্রিয়াসংক্রান্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে সাপের কামড়ে। কিন্তু বিষয়টি ততটা গুরুত্ব পায় না। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ছয়টি বিভাগের গ্রামীণ তিন হাজার ৯৯৩টি পরিবারের ১৮ হাজার ৮৫৭ জনের ওপর জরিপ চালিয়ে এবং গবেষণার মাধ্যমে এ সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে।

সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট-২০০৯

0 comments: