Thursday, August 6, 2009

উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা

আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী
সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ

বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। সারা বিশ্বে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (ব্রেইন স্ট্রোক), হূদরোগ ও কিডনি রোগের এককভাবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। কাজেই এর চিকিৎসায় জনসচেতনতা সৃষ্টি এক বিশাল জনগোষ্ঠীর উপকারে আসবে। যেহেতু উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা প্রায়ই সারা জীবনের চিকিৎসা, কাজেই রোগীদের তাদের নিজেদের রোগ সম্পর্কে কিছুটা কার্যকর জ্ঞান রাখা প্রয়োজন।

একজন চিকিৎসক উচ্চ রক্তচাপের রোগীর চিকিৎসা করার সময় তিনটি দিকে নজর দেন। প্রথমত, রোগী সত্যি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে কি না এবং ভুগে থাকলে সেটি কোন পর্যায়ের উচ্চ রক্তচাপ; দ্বিতীয়ত, উচ্চ রক্তচাপের কারণে তার শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না; তৃতীয়ত, উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে তার হূদরোগের আর কোনো ঝঁুকি আছে কি না।
টারগেট ওরগান ড্যামেজ বা টিওডি বলতে বোঝায় উচ্চ রক্তচাপ দেহের যেসব প্রধান অঙ্গের ক্ষতিকর পরিবর্তন আনে সেগুলোকে। এর মধ্যে আছে হূৎপিণ্ডে দেয়াল পুরু বা মোটা হয়ে যাওয়া এবং হার্ট ফেইলিওর হওয়া, কিডনি ড্যামেজের জন্য রক্তের ক্রিয়েটিনিন সামান্য বেড়ে যাওয়া (১.৩-১.৫ মিলি গ্রাম %) বা প্রস্রাবে সামান্য প্রোটিন যাওয়া, চোখের রেটিনায় অতিরিক্ত রক্তচাপের জন্য রক্তনালির পরিবর্তন বা রক্তপাত, আর রক্তবাহী ধমনির দেয়ালে অ্যাথেরোসক্লেরোটিক প্লাক (চর্বির চর) জমে ধমনির দেয়াল মোটা হয়ে যাওয়া (বিশেষত ক্যারোটিড ধমনিতে, যেটি মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করে)। পূর্ববর্তী হার্টের ব্যথা বা এনজাইনা এবং হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস; পূর্ববর্তী বাইপাস অপারেশন বা এনজিওপ্লাস্টির (রিং বসানো) ইতিহাস কিংবা পূর্ববর্তী ব্রেইন স্ট্রোক থাকলে একটি উচ্চ রক্তচাপের রোগীর ভবিষ্যতে বড় কোনো কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি স্বভাবতই অনেক বেড়ে যায়।

কার্ডিওভাসকুলার রিস্ক বলতে বোঝানো হয় উচ্চ রক্তচাপ ছাড়াও ধূমপান, ওজন বেশি হওয়া, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল বেশি হওয়া, কিডনির ক্ষতি হওয়া, বয়স (পুরুষদের ক্ষেত্রে ৫৫ বছরের বেশি, মেয়েদের ক্ষেত্রে ৬৫ বছরের বেশি), পারিবারিক হূদরোগের ইতিহাস ও শারীরিক পরিশ্রম কম করা।

একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগীর চিকিৎসা করতে গেলে চিকিৎসক দুটি বিশেষ টার্গেটে দৃষ্টি দেবেন। প্রথমত, রক্তচাপকে সুনির্দিষ্ট স্তরে নামিয়ে আনা; দ্বিতীয়ত, তার টিওডি ও কার্ডিওভাসকুলার ঝঁুকিগুলো ভালো করে অনুসন্ধান করে সেগুলো যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনা।

কোনো ঝঁুকি (রিস্ক ফ্যাক্টর) বা টিওডি ছাড়া রোগীর রক্তচাপ ১৪০/৯০-এর নিচে আনতে পারলেই চলবে। কিন্তু ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর অথবা টিওডি থাকলে সে ক্ষেত্রে টার্গেট হলো ১৩০/৮০-এর নিচে। যদি কিডনি ড্যামেজ থাকে, তবে টার্গেট প্রেসার হলো ১২৫/৭৫ বা এর নিচে।

এই লক্ষ্য সামনে রেখে চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসায় এগোবেন দুটি পদ্ধতিতে। একটি হচ্ছে, রোগীর জীবন যাপন পদ্ধতি বা লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করবেন। আরেকটি হলো, প্রয়োজনীয় ওষুধ দেবেন। প্রথমটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সব রোগীর জন্যই প্রযোজ্য। অনেক রোগীর জন্য এবং প্রি-হাইপারটেনশন গ্রুপের রোগীদের জন্য শুধু এটিই যথেষ্ট। খাবারে সোডিয়াম অর্থাৎ লবণ একদম কমিয়ে দেওয়া, পটাশিয়াম বেশি আছে এমন খাবার (যেমন−বিভিন্ন ফল ও সবজি) বেশি খাওয়া, খাদ্য তালিকায় অাঁশযুক্ত খাবার বাড়িয়ে দেওয়া। এগুলো রক্তচাপ কমাতে এবং ভবিষ্যতে উচ্চ রক্তচাপের রোগী না হতে সাহায্য করে। এবারের বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবসের (১৭ মে) স্লোগান ছিল ‘লবণ ও উচ্চ রক্তচাপ: দুটি নীরব ঘাতক। ভালো করে জানুন, দীর্ঘদিন বাঁচুন।’

খাবারের লবণ যদি অর্ধেক কমানো যায়, তবে সারা বিশ্বে বছরে ২৫ লাখ মানুষ ব্রেইন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা ক্রনিক কিডনি রোগ থেকে বেঁচে যেতে পারে।

চর্বিযুক্ত খাদ্যের সরাসরি রক্তচাপের ওপর প্রভাব নেই; তবে ওজন বাড়িয়ে ও রক্তের চর্বি বাড়িয়ে রক্তচাপ বাড়াতে পারে এবং হূদরোগের ঝুঁকিও অনেক বাড়িয়ে দেয়। খাদ্যের প্রোটিন যদি অ্যানিমেল সোর্স থেকে না এসে প্লান্ট সোর্স থেকে আসে (যেমন−ডাল, শাকসবজি ইত্যাদি), তবে তা বেশি উপকারী বটে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫ শতাংশ ওজন বাড়লে রক্তচাপ বাড়ার ঝুঁকি বাড়ে ২০-৩০ শতাংশ। ওজন কমলে তেমনি রক্তচাপও কমে আসে অনেক। ধূমপান বন্ধ করা রক্তচাপ কমার ওপর যতটা না প্রভাব ফেলে, এর চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমানোয়।
একইভাবে অ্যালকোহল গ্রহণে পরিমিতিবোধ রক্তচাপ যেমন কমিয়ে আনে, এরও বেশি কমায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি। শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম উপকার করে নানাভাবে। এটি ওজন কমায়, কোলেস্টেরল কমায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তচাপও কমায়। সপ্তাহের অধিকাংশ সময় (সম্ভব হলে সব দিন) ৩০-৪০ মিনিট মাঝারি পরিশ্রমের কাজ বা হাঁটা কিংবা ব্যায়াম করলেই এ উপকারটুকু পাওয়া সম্ভব। কাজেই হাঁটুন, দৌড়ান এবং লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।

মানসিক চাপ, বিশেষ করে কর্মস্থলের মানসিক চাপ রক্তচাপ বাড়ায়। কাজেই মানসিক চাপ এড়াতে নিজের শখের কিছু কাজ করুন। ছুটি নিন, বিশ্রাম নিন, আর সময়মতো ঘুমানোর অভ্যাস করুন।

এ সবকিছুই আপনার রক্তচাপ এবং কার্ডিওভাসকুলার ঝঁুকি কমাতে সাহায্য করবে। ওষুধ দেওয়ার সময় চিকিৎসক রক্তচাপের মাত্রা ও সম্পর্কিত অন্যান্য রোগ বা অসুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় নেন। রোগীর কোনো বিশেষ ওষুধে কোনো পাশ্র্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না বা রোগীর আর্থিক ক্ষমতা অনুযায়ী ওই ওষুধগুলো তার সামর্থেযর আওতায় কি না, এগুলোও কিন্তু বিবেচনার বিষয়।

শেষ কথাটি হলো, উচ্চ রক্তচাপের মতো একটি সারা জীবনের রোগের চিকিৎসায় রোগী আর চিকিৎসক দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই শুধু এনে দিতে পারে সফল ও দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসার সম্ভাবনা। কাজেই চিকিৎসক তাঁর জ্ঞান দিয়ে চিকিৎসার প্ল্যান করে দেবেন, রোগী তাঁর শ্রম, অর্থ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা দিয়ে সেই প্ল্যানটি বাস্তবায়ন করবেন। তাহলেই দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন যাপনে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব।

সূত্রঃ প্রথম আলো, ২০০৯

0 comments: