Wednesday, August 19, 2009

শিশু প্রথম বছরে গরুর দুধ খাবে না

প্রণব কুমার চৌধুরী
সহকারী অধ্যাপক, শিশুরোগ বিভাগ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

গরুর দুধ সব মানুষের জন্য পুষ্টি জোগানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। এটি তেমন এক খাদ্য, যাতে আছে প্রোটিন বা আমিষের উচ্চমান আর ক্যালসিয়াম ফসফরাসের মতো খনিজ পদার্থে পূর্ণ। তবু বৈজ্ঞানিক বিবেচনায় ইনফ্যান্ট বা শিশুর প্রথম বছরে গাভির খাঁটি দুধ খাওয়ানো পরিহার করা শ্রেয়।

এক বছরের কম বয়সী শিশুর খাবার নির্দিষ্ট করতে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা কিছু স্লোগানে ভর করে জনগণের কাছে যে বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, পর পর সাজানো হলে তা এ রকমই দাঁড়াবে−

১. বুকের দুধ শিশুর জীবনে শ্রেষ্ঠ সূচনা,
২. ছয় মাস পর্যন্ত শিশুর জন্য শুধু মায়ের দুধ,
৩. ছয় মাস পূর্ণ হলে বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার, যথা−খিচুড়ি খাওয়ানো শুরু করা,
৪. গাভির দুধ বাছুরের জন্য, মানবশিশুর জন্য মায়ের দুধ।
অর্থাৎ শিশুর প্রথম বছরে গরুর দুধ মানবশিশুর জন্য আর আদর্শ খাদ্য নয়। প্রথম বছর শিশু গরুর দুধ খাবে না, খাবে মায়ের দুধ; সঙ্গে ছয় মাস বয়স থেকে স্বাভাবিক খাবার।

গরুর দুধ বনাম মায়ের দুধ
খাদ্যশক্তি বিচারে গরুর দুধ ও মায়ের দুধে সমতা থাকলেও পুষ্টিগুণ বিচারে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য।

  • গরুর দুধে শ্বেতসার বা ল্যাকটোজের মান প্রতি ডেসিলিটার ৪.৭ গ্রাম, মায়ের দুধে যা ৭.১ গ্রাম। মায়ের দুধের এ ল্যাকটোজ অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম শোষণ করে নবজাত ও অল্পবয়সী শিশুর দেহ-অস্থি মজবুত করতে সহায়তা করে; সাহায্য করে গ্যালাকটোলিপিড তৈরির মাধ্যমে মস্তিষ্ককোষের বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনে। শিশু হয় বুদ্ধিমান ও স্বাস্থ্যবান।
  • গরুর দুধে আমিষ বা প্রোটিনের পরিমাণ খুব বেশি, যা প্রতি ডেসিলিটারে ৩.১ গ্রাম। এতে আছে ক্যাসিনের আধিক্য। আছে বিটা ল্যাকটোগ্লোবিনের উপস্থিতি। ফলে গরুর দুধ পানরত শিশু অ্যাকজিমা, আন্ত্রিক প্রদাহ ও মলে রক্তক্ষরণের সমস্যায় ভোগে। মায়ের দুধে প্রোটিন প্রতি ডেসিলিটারে ১.০৬ গ্রাম, শিশুর প্রয়োজনমতোই স্বাভাবিক।
  • গরুর দুধে চর্বি আছে প্রতি ডেসিলিটারে ৩.৮ গ্রাম, পরিমাণে তা মায়ের দুধের চেয়ে কম। আর নেই অতিজরুরি ফ্যাটি এসিড, যা শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি বিকাশের জন্য একান্ত জরুরি।
  • গরুর দুধে সোডিয়ামের মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ০.৭৭ গ্রাম, যা মায়ের দুধের চার গুণেরও বেশি। ক্যালসিয়াম ০.৪ গুণ, পটাশিয়াম ৩ গুণ ও ফসফরাস প্রায় সাড়ে ৬ গুণেরও বেশি। শুধু প্রয়োজনীয় জিংক ছাড়া অন্যান্য খনিজ পদার্থ, যেমন ম্যাগনেশিয়াম প্রভৃতি আছে বেশি মাত্রায়। এক বছরের কম বয়সী শিশুকে গরুর দুধ খাওয়ানো হলে এই অতিরিক্ত মাত্রার আমিষ ও খনিজ পদার্থ নিষ্কাশনে কিডনি বহু বিপত্তির সম্মুখীন হয়। গরুর দুধে অল্পবয়সী শিশুতে শোষিত হওয়ার মতো আয়রন কম পরিমাণে থাকে। ফলে এ বয়সে গরুর দুধ পানরত শিশু রক্তস্বল্পতার শিকার হয়।
  • গরুর দুধে কমবয়সী শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় ‘এ’ ও ‘সি’ ভিটামিন আছে কম মাত্রায়, আর কম মাত্রায় আছে ভিটামিন ‘ই’। শিশুকে মায়ের দুধ না দিলে গরুর দুধে নির্ভরশীল শিশুর ভিটামিনের স্বল্পতাজনিত অসুখ, যেমন রাতকানা, স্কার্ভি প্রভৃতি হতে পারে।
  • মায়ের দুধে শিশুর জন্য রোগপ্রতিরোধক যে শক্তিকাঠামো মজুদ আছে, যেমন ইমিউনোগ্লোবিউলিন ও লিউকোমাইট, ম্যাকোনেজ, নিউট্রোফিল, যা নেই গরুর দুধে। তাই গরুর দুধ পানে নির্ভরশীল শিশু সহজে রোগে আক্রান্ত হয়।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট-২০০৯

সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা

অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

বিশ্বজুড়ে মহামারির আশঙ্কা−এমন একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ বছর ১১ জুন। সংস্থাটি সংকেত দিল ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ (এইচ১এন১) বিশ্বজুড়ে মহামারি হয়ে আসছে: সতর্কতার মান ৬-এ উন্নীত করা হলো। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন এইচ১এন১ ভাইরাসের বিস্তারের ব্যাপকতা প্রতিফলিত হলো, ভাইরাসে রোগ গুরুতর কতখানি হলো, তা বিচার্য বিষয় ছিল না। ইতিমধ্যে ৭০টিরও বেশি দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জাএ (এইচ১এন১) সংক্রমণের কথা শোনা গেছে, আর বিশ্বের নানা অংশে এইচ১এন১ সংক্রমণ জনগোষ্ঠীতে প্রাদুর্ভাবের কথাও জানা গেছে।

বিশ্বব্যাপী মহামারি হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণার পর থেকে নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস ক্রমেই আরও বিস্তার লাভ করতে থাকল।

এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিবেদন পাওয়া গেল আরও অনেক দেশে, বর্তমানে প্রায় দ্বিগুণ। দক্ষিণ গোলার্ধে ফ্লুর প্রাদুর্ভাব যে ঋতুতে হয়, তাও এগিয়ে এল। আর জানা গেল নিয়মিত ফ্লুর সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণের কথাও। যুক্তরাষ্ট্রে এই এইচ১এন১ ভাইরাস সংক্রমণ গ্রীষ্নেও বেড়েছে। বড় রকমের প্রাদুর্ভাবও হচ্ছে।

এই ভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটেছে। তবে বেশির ভাগ অসুস্থ মানুষ চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) ধারণা, রোগ আরও বাড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রে আরও মৃত্যু ঘটবে গ্রীষ্ন পেরিয়ে শীতকাল পর্যন্ত। নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস, সেই সঙ্গে নিয়মিত ফ্লু, দুটি মিলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এইচ১এন১ ভাইরাস হলো শূকরের উৎস থেকে আসা একটি নতুন ফ্লু ভাইরাস। এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রথম ঘটেছিল মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রে, ২০০৯ সালের মার্চ ও এপ্রিলে।

ধারণা করা হয়েছিল যে নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ ভাইরাস ছড়ায় নিয়মিত ফ্লুর সংক্রমণের মতোই, মূলত ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের কফ ও হাঁচির মাধ্যমে। তবে সংক্রমিত বস্তু স্পর্শ করে হাত, নাক ও মুখে লাগালেও তা সংক্রমিত হতে পারে। নতুন এইচ১এন১ সংক্রমণ নানা রকমের উপসর্গ ঘটাতে পারে ফ্লু জ্বরের, যেমন−জ্বর, কফ, গলা খুসখুস, শরীরে ব্যথা, মাথা ধরা, গা শিরশির করা ও ক্লান্তি। অনেকের হয় বমি ভাব, বমি ও তরল মল।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইচ১এন১ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সিডিসির ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় প্রমাণিত হলো এ বছর ১৫ এপ্রিল। দ্বিতীয় রোগী প্রমাণিত হলো এর দুই দিন পর। এতে বোঝা গেল, ভাইরাসটি একজন লোকের কাছ থেকে অন্যের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।

নতুন পরিস্থিতিতে সিডিসি নানা রকম নির্দেশিকাও দিল
চিকিৎসকদের জন্যও এল গাইডলাইন। নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস রোগী শনাক্ত করা, তাদের পরিচর্যা এবং ভাইরাসরোধী ওষুধ ব্যবহারের জন্য দেওয়া হলো অন্তর্বর্তী বিশেষ নির্দেশিকা। এ ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাবে এসব ওষুধ ব্যবহারের অগ্রাধিকার দেওয়া হলো−ফ্লুতে আক্রান্ত ও হাসপাতালে ভর্তি রোগী, গুরুতর রোগের আশঙ্কা এমন লোক, গর্ভবতী মহিলা, ছোট শিশু এবং ডায়াবেটিস, হাঁপানি, হূদরোগ ও ফুসফুসের ক্রনিক রোগে আক্রান্ত লোককে।

জনগণের জন্যও এল নির্দেশিকা
ফ্লুজনিত উপসর্গে অসুস্থ হলে কী করা উচিত, সে সম্পর্কে নির্দেশিকা দেওয়া হলো জনগণের জন্য। কীভাবে ঘরে অসুস্থ লোকের পরিচর্যা করা যায়, নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ কমানোর জন্য মুখের মাস্ক ও রেসপিরেটর কী করে ব্যবহার করা যায়−এ নিয়েও নির্দেশিকা এল। জীবাণুর বিস্তার রোধে প্রত্যেকেরই প্রতিদিন নেওয়া উচিত প্রতিষেধক ব্যবস্থা, যেমন−বারবার হাত ধুয়ে ফেলা। যারা অসুস্থ তারা গৃহবাসী হয়ে থাকবে। বাইরে বেরোবে না কিছুদিন। আর রোগের আরও বিস্তার যাতে না হয় সে জন্য সুস্থ লোকের সঙ্গে সংস্পর্শ এড়িয়ে চলবে।

ভাইরাস পরীক্ষা করে দেখার জন্য পদ্ধতিও উদ্ভাবিত হয়েছে
এই নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস শনাক্ত করার জন্য একটি পিসিআর রোগ-নির্ণয়ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছে সিডিসি। এটি প্রাপ্তি সাধ্য করা হচ্ছে সব দেশে।

টিকা: এ নিয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সিডিসি ও আমেরিকান সরকার। সিডিসি শনাক্ত ও পৃথক করেছে নতুন এইচ১এন১ ভাইরাস। তবে টিকা আবিষ্কার সহজ নয়। এতে সময় লাগবে।

ইনফ্লুয়েঞ্জা: নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে নতুন এই ভাইরাসের সন্ধান মিলেছে। দেখা যাচ্ছে, অনেক দেশে নতুন ফ্লু বেশি হচ্ছে।

  • দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে সবার
  • সবাইকে জানতে হবে নতুন এই ফ্লু সম্পর্কে।
  • স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সবাইকে এ সম্পর্কে অবগত করবেন এবং বাড়তি সংবাদ পাওয়ামাত্র সবাইকে জানাবেন।
  • যে স্থানে এর প্রাদুর্ভাব হয়, সেখানে প্রত্যেকে প্রতিদিন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ও নতুন ভাইরাসের বিস্তার রোধ করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেবেন:
  • কফ, কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় নিজের নাক-মুখ টিস্যু নিয়ে ঢেকে নিতে হবে। ব্যবহারের পর এই টিস্যু আবর্জনার পাত্রে ফেলে দিতে হবে।
  • হাত দুটি বারবার সাবানপানি দিয়ে ধুতে হবে, বিশেষ করে কফ-কাশি বা হাঁচি দেওয়ার পর। অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড ক্লিনার বেশ উপযোগী।
  • চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা এড়াতে হবে। জীবাণু এভাবে ছড়ায়।
  • রোগীদের কাছাকাছি যাওয়া চলবে না।
  • ফ্লুর মতো অসুখে আক্রান্ত মনে হলে, লক্ষণ উপসর্গ শুরু হওয়ার পর সাত দিন অথবা লক্ষণ উপসর্গ মুক্ত হওয়ার পর আরও ২৪ ঘণ্টা, সে সময়টি দীর্ঘ, তত দিন ঘরে অবস্থান করতে হবে। এতে অন্যজন সংক্রমিত হওয়া বা ভাইরাসের আরও বিস্তার হওয়া রোধ হবে।
  • কোথাও ফ্লুর প্রাদুর্ভাব ঘটলে সে অঞ্চলে জনস্বাস্থ্য কতর্ৃপক্ষের পরামর্শমতো স্কুল বন্ধ করা, ভিড় এড়ানো এবং সামাজিক সম্মেলন বা মেলামেশা এড়ানোর মতো কাজ করতে হবে।
প্রচণ্ড তাপমাত্রায় জ্বর, জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, হাঁচি, কাশি। এ হলো লক্ষণ। হাঁচি-কাশির সময় রুমাল, গামছা, কাপড়, টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢাকা, দিনে কয়েকবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা। এমন লক্ষণ হলে বাড়িতে থাকা এবং চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে পরামর্শ নেওয়া। তবে জ্বর ছাড়াও এই ফ্লু হওয়ার খবর রয়েছে কিছু দেশের বেশ কিছু রোগীর।

আমাদের দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ এইচ১এন১ ভাইরাসে আক্রান্ত লোক পাওয়া গেছে কয়েকজন, যারা সবাই বিদেশ প্রত্যাগত। এই ভাইরাস সংক্রমণকে সফলভাবে মোকাবিলা করেছে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি, প্রতিরোধব্যবস্থা বজায় রাখা এবং তদারকি ও নজরদারি রাখতে হবে। গত পরশু পর্যন্ত যা খবর তা হলো, দেশে ৩৪ ব্যক্তি এতে আক্রান্ত। তবে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। সরকার সব হাসপাতালে সোয়াইন ফ্লু ইউনিট গঠনের নির্দেশ দিয়েছে। এ রোগ হলে রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা যেতে পারে মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআরএ) এবং আন্র্তজাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআরবি)। তবে কেবল সরকার নয়, ফ্লু ঠেকাতে সবাইকে দলমতনির্বিশেষে এগিয়ে আসতে হবে।
লালা ও রক্ত পরীক্ষার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে আইইডিসিআরএতে, চিকিৎসার জন্য ওষুধও রয়েছে সেখানে।

বর্তমানে একে এক নম্বর স্বাস্থ্য-সমস্যা হিসেবে চিহ্ণিত করে সবাইকে নিয়ে সরকার সোয়াইন ফ্লু মোকাবিলার উদ্যোগ নিয়েছে।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট-২০০৯

জরুরি পরামর্শ-ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভালোভাবে জানাকেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ব্যবস্থা বলে গণ্য করা হয়। এ জন্য কোন কোন অবস্থায় রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানতে হবে এবং কী ধরনের জটিলতা দেখা দিলে কীভাবে সমাধান করতে হবে, তা রোগী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও রমজানের আগেই শিখতে হবে।
মনে রাখতে হবে, সবার জন্য একই ব্যবস্থা প্রযোজ্য নয়। প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগীর অবস্থা অনুসারে আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোজার সময় রক্তে সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখার জন্য রোগীর কী কী করণীয়, সে সম্পর্কে চিকিৎসক আপনাকে পরামর্শ দেবেন। বিশেষ করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া যাতে না হয়, সে জন্য সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।

  • রোজার সময় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করবেন না, এতে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে।
  • রোজার সময় দিনে ও রাতে সুগার মাপা উচিত। ধর্মবিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে জানা গেছে, এতে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না।
  • সেহরির খাবার সেহরির শেষ সময়ের কিছু আগে খাওয়া উচিত। ইফতারের সময় বেশি চিনিযুক্ত খাবার খাবেন না।
  • রোজার সময় দিনের বেলা অতিরিক্ত ব্যায়াম করা উচিত নয়।
  • রোজার সময় রাতের বেলা পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট-২০০৯

ডায়াবেটিক রোগীর রোজার প্রস্তুতি

মো. ফরিদ উদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক, অ্যান্ডোক্রাইন মেডিসিন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশির ভাগ ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখেন। ডায়াবেটিসের রোগী, যাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোজা রাখেন, তাঁরা বেশ কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন। বিশেষ করে রক্তে শর্করা বা চিনির স্বল্পতা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া), রক্তে শর্করা বা চিনির আধিক্য (হাইপারগ্লাইসেমিয়া), ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস ও পানিশূন্যতা। যাঁরা শুধু খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন, তাঁদের রোজা রাখার ঝুঁকি কম। যাঁরা মেটফরমিন ও গ্লিটাজোনস-জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করেন, তাঁদেরও এ সময় ঝুঁকি কম।

তবে যাঁরা সালফোনাইলইউরিয়া ও ইনসুলিন গ্রহণ করেন, তাঁদের ঝুঁকি বেশি। যাঁদের সামর্থয আছে, তাঁদের রোজা রাখতে ডায়াবেটিস কোনো বাধা নয়। তবে প্রয়োজন পূর্বপ্রস্তুতি। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে রোজা রাখার প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। ডায়াবেটিসের রোগীদের রোজা রাখা সহজ ও নিরাপদ। রোজা রাখা অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজন হলে চামড়ার নিচে ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়া যেতে পারে। ধর্মবিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, এতে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। সুতরাং এসব নিয়ম মেনে ডায়াবেটিক-রোজাদার রোজা রাখতে পারবেন। ডায়াবেটিসের সঙ্গে অন্য জটিলতা যাঁদের আছে, তাঁদের রোজা রাখা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো।


রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)
দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে দিনের শেষভাগে স্বাস্থ্যের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। অতিরিক্ত কাজ করায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যেতে পারে। বড় ধরনের শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম রক্তের গ্লুকোজের বড় একটা অংশ কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ইনসুলিন অথবা ট্যাবলেট গ্রহণ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ইনসুলিন ও সিরিঞ্জ একই মাপের না হলে, বরাদ্দের চেয়ে খাবার খুব কম খেলে বা খাবার খেতে ভুলে গেলে এ অবস্থা হতে পারে।

হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ
অসুস্থ বোধ করা। বুক ধড়ফড় করা। শরীর কাঁপতে থাকা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসা। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। খিদে বেশি পাওয়া। বেশি ঘাম হওয়া। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা। অস্বাভাবিক আচরণ করা। খিঁচুনি হওয়া।

হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে কী করতে হবে
রোজাদার ডায়াবেটিক রোগীর এসব লক্ষণ দেখা দিলে অথবা রক্তে সুগারের পরিমাণ ৬০ মিলিগ্রামের (৩.৬ মিলিমোল) নিচে হলে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। পরবর্তী সময়ে কাজা রোজা রাখতে হবে। হাইপোগ্লাইসেমিয়া একটি জরুরি অবস্থা। এ রকম হলে রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে চা-চামচের চার থেকে ছয় চামচ গ্লুকোজ বা চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলে খাওয়াতে হবে। গ্লুকোজ বা চিনি না থাকলে যেকোনো খাবার সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে। রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা না করে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়ানোর উপায়
এমন খাবার ও ওষুধ খেতে হবে, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখবে। খাবার ও ওষুধ খাওয়ায় সমন্বয় সাধন করতে হবে। নিচের নিয়মগুলো মেনে চললে হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়ানো সম্ভব। কঠিন শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ বাদ দিতে হবে। কেননা, এটি কোনো রকম আভাস ছাড়াই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে অত্যন্ত নিম্নমুখী করে দেয়। দেরিতে ইফতার করায়ও এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। বারবার ওষুধের মাত্রার হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে, সেটি ইনসুলিন হোক কিংবা ট্যাবলেট। একইভাবে খাবারের পরিমাণেরও হিসাব রাখতে হবে, বিশেষ করে শর্করার পরিমাণ। এরপর এই হিসাব বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসককে জানাতে হবে, যেন খাবারের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের প্রভাব উচ্চমাত্রা এবং ওষুধের সাহায্যে রক্তে গ্লুকোজের প্রভাব নিম্নমাত্রা এই দুইয়ের সমতা রক্ষা হয়।

গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া)
ডায়াবেটিস রোগে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে অনেক রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়। ইনসুলিনের ঘাটতির কারণে কম সময়ে এসিটোন বেড়ে অবস্থা জটিল হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে প্রধান যে অবস্থাগুলো প্রকাশ পায়, সেগুলো হলো মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, কখনো কখনো ঝিমুনি, বমি প্রভৃতি।
এ ছাড়া রক্তের গ্লুকোজের কার্যক্রম অনিয়মতান্ত্রিক হয়ে পড়ায় অতিরিক্ত প্রস্রাব, পিপাসা ও পানিশূন্যতা দেখা যায়। এ সময় রক্তচাপ নিম্নমুখী হয়, ত্বক শুকিয়ে যায়, প্রস্রাবে গ্লুকোজ বেশি মাত্রায় প্রকাশ পায় এবং সেই সঙ্গে প্রস্রাবে এসিটোন দেখা যায়। এ অবস্থায় যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না হয়, তাহলে কিটোএসিডোসিস হবে এবং রোগী বিপজ্বনক অবস্থায় পৌঁছাবে।
রোজা থাকা অবস্থায় এ রকম হলে রোজা ভেঙে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিটোএসিডোসিস ছাড়াও যদি রক্তের সুগার বিপজ্বনক অবস্থায় পৌঁছায় (১৬.৭ মিলিমোল/লি. বা ৩০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার), তাহলে ত্বকের নিচে ইনসুলিন দিয়ে সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। পরবর্তী সময়ে শুধু ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করতে হবে।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট-২০০৯

Tuesday, August 11, 2009

বন্ধুত্ব সুস্থ জীবনের জন্য

মুনতাসীর মারুফ
চিকিৎসা কর্মকর্তা
মাদারগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জামালপুর

পারস্পরিক সম্পর্কের বাঁধন ছাড়া মানুষ কখনোই আধুনিক সভ্যতার এই স্তরে পৌঁছাতে পারত না। বর্তমানে হয়তো প্রস্তরযুগের মতো খাবার খুঁজতে বের হওয়ার জন্য বা হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণ থেকে জীবন রক্ষা করতে একত্র হওয়ার প্রয়োজন তেমন পড়ে না, কিন্তু এ যুগেও সুস্থ, সুখী, দীর্ঘ জীবনের জন্য বন্ধুত্বের ভূমিকা অপরিসীম। অভিজ্ঞতা থেকে যেমন আমরা তা বুঝতে পারি, তেমনি বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার মাধ্যমেও এই ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত।

হূদ্যন্ত্রের সুস্থতার ওপর বন্ধুত্বের প্রভাব রয়েছে। সুইডেনের একদল গবেষক ১৩ হাজার ৬০০ জনের ওপর তিন বছর গবেষণা চালিয়ে দেখতে পান, যাদের বন্ধুবান্ধব কম বা নেই, তাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেশি। নিউইয়র্কের গবেষকেরাও এ বছর প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানিয়েছেন, বন্ধুহীন ব্যক্তিরা হূদরোগ, উদ্বেগজনিত রোগ ও বিষণ্নতায় বেশি ভোগে। বন্ধুত্ব কীভাবে হূদ্যন্ত্র বা আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে? উত্তরে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জার্নাল অব দ্য ন্যাশনাল মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-এ বলা হয়েছে, ভালো বন্ধুত্ব মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এই মানসিক চাপের সঙ্গে সম্পর্ক আছে হূদরোগের। মানসিক চাপের ফলে রক্তনালির ভেতর প্রদাহের ঝুঁকি বাড়ে, যা পরবর্তী সময়ে রক্তের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত করতে পারে; নালির ভেতর রক্ত জমে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।

হামবোল্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী তাশা আর হাউই বলেন, মানুষের ক্রমবিকাশের ধারা বা অভিব্যক্তিবাদেই রয়েছে এর উত্তর। মানুষ সামাজিক জীব। তাদের জন্নই হয়েছে সমাজবদ্ধ হিসেবে বাস করার জন্য। আর তাই সামাজিক বন্ধন দৃঢ়, এমন ব্যক্তিরা অন্যদের চেয়ে বেশি মানসিক প্রশান্তি অনুভব করে, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। ফলে তাদের হূদরোগ কম হয়, রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা বেশি থাকে এবং চাপসঞ্চারী হরমোন কর্টিসোলের পরিমাণ দেহে কম থাকে। পিটসবার্গের কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শেলডন কোহেন বলেন, জীবনের কষ্টকর সময়গুলো মোকাবিলা করতে বন্ধু সহায়তা করে।

তারা চাপ মোকাবিলার জন্য মানসিক অবলম্বন হিসেবে দুঃসময়ে পাশে থাকে। যাদের সামাজিক যোগাযোগ বেশি, তারা অধিকতর আত্মবিশ্বাসী হয় এবং জীবন ও পরিবেশের ওপর নিজেদের পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ অনুভব করে। বন্ধুত্ব স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণকেও উৎসাহিত করে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সুখ সংক্রামক।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকেরা বলেছেন, সুখ ব্যাপারটি সংক্রামক ভাইরাসের মতোই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একজনের কাছ থেকে অন্যজনে ছড়ায়। সুতরাং আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যদি সুখী হয়, সে ক্ষেত্রে আপনারও সুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অপরদিকে সমাজবিচ্ছিন্ন, বান্ধবহীন জীবন একই সঙ্গে অসুস্থ ও অসুখীও। বয়সী একাকী ব্যক্তিরা উচ্চ রক্তচাপ ও নিদ্রাহীনতায় বেশি ভোগেন। অস্থিরতা ও উদ্বেগে আক্রান্ত হন। তাঁদের দেহে স্ট্রেস হরমোনের পরিমাণ বেশি থাকে। রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা থাকে কম।

হার্ট অ্যাটাকের পর দ্রুত মৃত্যুর ঝুঁকি তাঁদের ক্ষেত্রে বেশি। শিকাগোর রাশ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের গবেষকেরা দেখেছেন, একাকিত্বে ভোগা ব্যক্তিদের স্মৃতিভ্রংশ রোগ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ। ২০০৬ সালে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত তিন হাজার সেবিকার ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুহীন রোগীদের ক্যান্সারে মারা যাওয়ার ঝুঁকি, যাদের দশের অধিক বন্ধু আছে তাদের চেয়ে চার গুণ বেশি। একইভাবে, জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের ওপর চালানো অন্য গবেষণায় প্রায় একই ধরনের ফল পাওয়া গেছে। বন্ধুত্বের যেসব উপকারিতার কথা বলা হচ্ছে, অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সেগুলো ভালো বন্ধুত্বের ফল।

বিপথগামী বন্ধুরা অবশ্যই আপনার স্বাস্থ্যের জন্যও বড় হুমকি। যারা অনিয়ন্ত্রিত ও অসুস্থ জীবনাচরণে অভ্যস্ত, তারা আপনাকেও স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপনের পথে নিয়ে যেতে পারে। আপনি হয়ে পড়তে পারেন ধূমপায়ী, মাদকাসক্ত, শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ। তাই সুস্থ, দীর্ঘ জীবনের জন্য খঁুজে নিন প্রাণবন্ত, সুখী, পরোপকারী, বিশ্বস্ত, ভালো বন্ধু; গড়ে তুলুন নির্মল বন্ধুত্ব।

সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট-২০০৯

তেজস্ক্রিয়তা থেকে গর্ভের শিশুকে বাঁচান

মো. তারিকুল ইসলাম রেডিওলজি ও ইমেজিং বিশেষজ্ঞ
এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট

গর্ভস্থ শিশু বিভিন্নভাবে তেজস্ক্রিয় রশ্মির সংস্পর্শে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত গর্ভস্থ শিশুর মা তেজস্ক্রিয় রশ্মির সংস্পর্শে আসেন এবং এরই একাংশ গর্ভস্থ শিশুর কাছে পৌঁছে যেতে পারে। আবার গর্ভবতী মা অনেক সময় চিকিৎসাগত কারণে তেজস্ক্রিয় পদার্থযুক্ত ওষুধ খেয়ে থাকেন, যা মায়ের মূত্রাশয়ের দেয়ালে অনেক দিন জমা থাকে এবং মূত্রাশয়ের পেছনে অবস্থিত জরায়ু ও ভ্রূণের ওপর তেজস্ক্রিয় রশ্মি ছড়িয়ে দিতে পারে।

সারা বিশ্বেই মানুষ প্রতিনিয়ত অল্পমাত্রায় তেজস্ক্রিয় রশ্মির সম্মুখীন হচ্ছে। একে বলা হয় প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা। এর উৎস হচ্ছে প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ, বিভিন্ন মহাজাগতিক রশ্মি, যা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে চলে আসে। প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা অল্প মাত্রায় বিরাজ করে, তবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা যত বেশি হয়, এর মাত্রা ততই বাড়তে থাকে।

তেজস্ক্রিয় রশ্মির কার্যকর মাত্রার একককে বলা হয় মিলি সিভার্ট। সাধারণভাবে একজন মানুষ বছরে তিন মিলি সিভার্ট প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হয়। তিন মিলি সিভার্ট তেজস্ক্রিয়তা মা ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে অনেক কম। প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা ছাড়াও একজন গর্ভবতী মা তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা পদার্থের সম্মুখীন হতে পারে−এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, ফ্লুরোস্কোপি (বিশেষ ধরনের এক্স-রে) পরীক্ষা করালে, ক্যানসার চিকিৎসার জন্য রেডিওথেরাপি গ্রহণ করলে কিংবা তেজস্ক্রিয় পদার্থযুক্ত ওষুধ গ্রহণ করলে।

একজন গর্ভবতী মা বেশি মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হলে তাঁর গর্ভস্থ ভ্রূণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সে জন্য গর্ভবতী মায়েদের এ ধরনের পরীক্ষা করাতে বা চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

সাধারণভাবে বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার যে মাত্রা ব্যবহার করা হয়, তা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার তুলনায় অনেক বেশি। একবার বুকের এক্স-রে করালে একটা মানুষ যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসে, তা প্রায় ১০ দিনের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমান, যার কার্যকর মাত্রা প্রায় ০.১ মিলি সিভার্ট। কিডনি ও মূত্রাশয় পরীক্ষার জন্য আইভিপি বা ইন্টর্্রাভেনাস পাইলোগ্রাম পরীক্ষায় ব্যবহূত তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ এক বছরের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমান।

পেটের সিটিস্ক্যান, খাদ্যনালির সিটিস্ক্যান (সিটি কোলোনোগ্রাফি) ও খাদ্যনালির এক্স-রেতে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয়, তা প্রায় তিন বছরের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমমাত্রার। একজন মানুষ মাথার সিটিস্ক্যান করালে যে মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হন, তা প্রায় আট মাসের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমান। আবার বুকের সিটিস্ক্যান কিংবা মেরুদণ্ডের সিটিস্ক্যানে ব্যবহূত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা প্রায় দুই বছরের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমমাত্রার।

আশার কথা হলো, রোগ নির্ণয়ে ব্যবহূত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি এটা ঠিক, কিন্তু ভ্রূণের বা গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হওয়ার জন্য যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তার প্রয়োজন, তার তুলনায় অনেক কম। গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষতি হওয়ার জন্য সাধারণভাবে ২০০ মিলি সিভার্ট তেজস্ক্রিয়তার প্রয়োজন। তবে ভ্রূণের বয়স দুই সপ্তাহের কম হলে ৫০ মিলি সিভার্ট তেজস্ক্রিয়তায় গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মা বুঝতেই পারেন না যে তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন। রোগ নির্ণয়ের জন্য যে পরীক্ষাগুলো করা হয়, এর মাত্রা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ১০ মিলি সিভার্টের চেয়ে কম হয়। সে ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় রশ্মি দিয়ে এই পরীক্ষাগুলো সাধারণভাবে নিরাপদ। আবার একজন গর্ভবতী মা তেজস্ক্রিয় রশ্মি দিয়ে পরীক্ষা করালেই যে তা ভ্রূণের কাছে পৌঁছে যাবে, তা নয়। তেজস্ক্রিয় রশ্মি সরল পথে চলাচল করে, কাজেই জরায়ু ও এর আশপাশের অঙ্গের পরীক্ষা করালেই কেবল ভ্রূণ প্রত্যক্ষ তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হয়। দূরবর্তী অঙ্গের পরীক্ষা করালে কিছু বিক্ষিপ্ত রশ্মি ভ্রূণ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, তবে এর মাত্রা অনেক কম।

যেসব অঙ্গের পরীক্ষায় সরাসরি ভ্রূণে তেজস্ক্রিয়তা পৌঁছার সম্ভাবনা রয়েছে, এর মধ্যে আছে মেরুদণ্ডের নিচের অংশের এক্স-রে বা সিটিস্ক্যান, কিডনি ও মূত্রাশয় দেখার জন্য আইভিপি, জরায়ুর গঠন দেখার জন্য এক্স-রে হিস্টেরোসালফিঙ্গোগ্রাম, তলপেট বা হিপ-জয়েন্টের পরীক্ষা, ক্ষুদ্রান্ত ও বৃহদন্ত্রের পরীক্ষা ইত্যাদি।

তবে রোগ নির্ণয় ছাড়াও চিকিৎসার জন্য তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহূত হতে পারে। সাধারণত ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া থাইরয়েডের ক্যান্সার বা হাইপার থাইরোয়েডিজমের জন্য তেজস্ক্রিয় পদার্থযুক্ত ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এ ক্ষেত্রে বেশি হতে পারে কিংবা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, যা ভ্রূণের জন্য ক্ষতিকর।

গর্ভস্থ শিশুর ওপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব তার বয়স, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ও তেজস্ক্রিয়তার সময়ের ওপর নির্ভর করে। গর্ভস্থ শিশু যত কম বয়সে তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হয়, তেজস্ক্রিয়তার সংবেদনশীলতা তত বেশি থাকে; অর্থাৎ ক্ষতির আশঙ্কা, ব্যাপকতা বেশি থাকে; আবার তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এবং বেশি সময় ধরে এর কার্যকারিতা থাকলে স্বভাবতই ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।
গর্ভস্থ শিশু তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হলে তার জন্ন-পরবর্তী ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং এ ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ও সময় যত বাড়বে, ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তত বাড়বে।

গর্ভধারণে সক্ষম যেকোনো নারীর চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তাঁর চিকিৎসককে জানানো প্রয়োজন যে তিনি গর্ভবতী কি না অথবা গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক প্রথমে গর্ভধারণের ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন। তারপর রোগীর চিকিৎসাপত্র দেবেন। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক গর্ভবতী মা ও ভ্রূণের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ এবং তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার আছে, এমন পরীক্ষা ও ওষুধ যথাসম্ভব বাদ দেবেন।

অনেক সময় দেখা যায়, একজন মহিলা এক্স-রে, সিটিস্ক্যান ইত্যাদি পরীক্ষা করার পর বুঝতে পারেন, তিনি ওই পরীক্ষা করার সময় গর্ভবতী ছিলেন। এ ক্ষেত্রে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কারণ রোগ নির্ণয়ে ব্যবহূত তেজস্ক্রিয় রশ্মির পরিমাণ অনেক কম থাকে, ফলে ক্ষতির ঝুঁকিও কম। আবার জরায়ুর দূরবর্তী অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোর পরীক্ষায় (যেমন−মায়ের মাথা, হাত, পা, বুকের পরীক্ষা) ভ্রূণের ওপর প্রত্যক্ষ তেজস্ক্রিয় রশ্মি পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে অতি অল্প মাত্রায় কিছু বিক্ষিপ্ত রশ্মি ভ্রূণের সংস্পর্শে আসতে পারে এবং ক্ষতির আশঙ্কাও খুব কম।

যেসব ক্ষেত্রে ভ্রূণের ওপর সরাসরি তেজস্ক্রিয় রশ্মি পড়ার ঝুঁকি আছে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে বিকল্প পরীক্ষা বা চিকিৎসার চেষ্টা করা উচিত।

জরায়ুর বাইরের বিভিন্ন
অঙ্গ-প্রতঙ্গের পরীক্ষার ক্ষেত্রে পেটের ওপর তেজস্ক্রিয়তা প্রতিরোধক পর্দা (লেড অ্যাপ্রোন) রাখার জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বা কর্তব্যরত যিনি আছেন তাঁকে অনুরোধ করুন।

গর্ভবতী অবস্থায় বিমান ভ্রমণ: দূরপাল্লার বিমানগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচু দিয়ে যাতায়াত করে। ভূপৃষ্ঠ থেকে যত ওপরে যাওয়া যায় ততই প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। অল্প সময়ের জন্য অনিয়মিত বিমান ভ্রমণে গর্ভবতী মা বা ভ্রূণের ক্ষতির আশঙ্কা বেশ কম। তবে যাঁরা ঘন ঘন দূরপাল্লার বিমানে ভ্রমণ করে থাকেন, তাঁদের নিজেদের ওপর তেজস্ক্রিয়তার মাত্রার হিসাব রাখা প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত সফটওয়্যারের সাহায্য নিতে হবে এবং প্রাপ্ত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অনুসারে কার্যতালিকায় পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন, রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ গ্রহণ, সব ক্ষেত্রেই কিছু ক্ষতি আর কিছু উপকারী দিক আছে।

উপকারের পাল্লা ভারী হলে তখনই কেবল নির্দিষ্ট পরীক্ষা করানো হয় এবং চিকিৎসাপত্র দেওয়া হয়। তেজস্ক্রিয়তারও কিছু ক্ষতিকর দিক আছে, তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে এবং সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করলে এর থেকে আমরা সর্বোচ্চ উপকার পেতে পারি।

সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট-২০০৯

মন ভালো তো হূদযন্ত্র ভালো

আহমেদ হেলাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হূদয় বা মন, এর সঙ্গে হূদ্যন্ত্রের সত্যিকারের যোগাযোগ কতটুকু, তা নিয়ে যতই বিতর্ক আর গবেষণা চলুক, এ কথা আজ নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত যে মনের সমস্যার সঙ্গে হূদরোগের একটা সম্পর্ক রয়েছে। ব্যক্তিত্বের ধরন, মনের অসুখ, চাপ, উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতা ইত্যাদি মানসিক অবস্থা হূদরোগের অন্যতম কারণ বলে আবিষ্কৃত হয়েছে।

সাম্প্রতিককালে এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী বহু গবেষণা হচ্ছে, মনের সমস্যার সঙ্গে হূদরোগের সম্পর্ক এখন প্রমাণিত সত্য, কিন্তু বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এইচ এফ ডাম্বার তাঁর ইমোশন অ্যান্ড বডিলি চেঞ্জ গ্রন্থে এ বিষয়ে গবেষণাপ্রসূত তথ্য দেন।

তিনি বলেন, আবেগের নানা রকম সমস্যা, মানসিক চাপ ও ব্যক্তিত্বের ধরন হূদরোগের অন্যতম একটি কারণ। তিনি সর্বপ্রথম ‘করোনারি পারসোনালিটি’ নামে ব্যক্তিত্বের প্রকরণ ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, এ ধরনের মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির হূদরোগ হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেশি। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের আচরণকে পরে ১৯৬০ সালে ফ্রাইডম্যান ও রোসেনম্যান ‘টাইপ-এ আচরণ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

পরবর্তী আরও গবেষণায় ১৯৭৫ সালে ফ্রাইডম্যান ও তাঁর সহযোগীরা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করেন, যাদের মধ্যে টাইপ-এ আচরণ দেখা যায় বা যারা করোনারি পারসোনালিটির অধিকারী, তাদের হূদরোগ হওয়ার আশঙ্কা সাধারণ মানুষের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি! কেমন আচরণ হয় করোনারি পারসোনালিটির মানুষের, আর টাইপ-এ আচরণই বা কী?

গবেষণায় এ ধরনের ব্যক্তিত্বের যে বৈশিষ্ট্য ও আচরণগুলো বের হয়ে এসেছে, তা হলো:

ক্রমাগত আবেগের সমস্যায় থাকা, সামান্য মনখারাপের বিষয়ে বেশি ভেঙে পড়া বা কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অত্যধিক আবেগ প্রকাশ করা। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আশপাশের মানুষের চেয়ে সুবিধাবঞ্চিত থাকা। অতিরিক্ত কাজের চাপ ও কর্মপরিধির মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে মানসিক চাপ বোধ করা। কোনো কারণ ছাড়াই পারিপাশ্র্বিকতার প্রতি বৈরী ভাব পোষণ করা (যেমন−এ দেশের সবাই খারাপ, সব মানুষ লোভী, কেউ ভালো নয়, সবাই আমার শত্রু ইত্যাদি মনে করা)।

সব সময় একটা প্রতিযোগিতামূলক আচরণ করা, বেশি পরিমাণে উচ্চাভিলাষী হওয়া (যেমন−অমুকের চেয়ে আমার এ বিষয়ে ভালো করতেই হবে, ওর আগে আমার প্রমোশন হতেই হবে, আমার সন্তানকে ছবি অাঁকার প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেতেই হবে ইত্যাদি মনোভাব)। কারণে-অকারণে সব কাজে তাড়াহুড়ো করা। সব সময় একটা পূর্বনির্ধারিত ‘ডেডলাইন’ মাথায় রাখা যে এ সময়ের মধ্যে বিষয়টির নিষ্পত্তি হতে হবে, সময়মতো না হলে তীব্র মানসিক চাপে ভোগা। হুট করে রেগে যাওয়া, অধৈর্য হওয়া, খিটখিটে আচরণ করা। এ ধরনের আচরণ আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিরা আক্রান্ত হতে পারে হূদ্যন্ত্রের যেকোনো রোগে, বিশেষত রক্ত সরবরাহ-সংক্রান্ত জটিলতায় (ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ), যার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে বুকে ব্যথা আর পরিণতিতে মৃত্যু।

এ তো গেল আচরণ আর ব্যক্তিত্বের কথা। এদিকে কিছু মানসিক রোগের সঙ্গেও সরাসরি হূদরোগের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা।

যেমন উৎকণ্ঠা (অ্যাংজাইটি) আর অনিয়ন্ত্রিত রাগের কারণে হতে পারে এনজিনা বা ব্যথাযুক্ত হূদরোগ। তীব্র বিষণ্নতা ও উৎকণ্ঠার যদি চিকিৎসা করা না হয়, তবে এ দুটি রোগ থেকে হতে পারে ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন’ নামের মারাত্মক হূদরোগ, যাতে মৃত্যুঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়াসহ নানা রকম মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহূত দু-একটি ওষুধ হূদ্যন্ত্রের ওপর পাশ্র্বপ্রতিক্রিয়া করতে পারে। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ ও হূদরোগ চিকিৎসায় ব্যবহূত কোনো কোনো ওষুধ বিষণ্নতাসহ আরও কিছু মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে।

সম্প্রতি আরেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যাদের সফলভাবে করোনারি বাইপাস সার্জারি বা হূৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ পরবর্তী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে মাঝারি থেকে তীব্র বিষণ্নতা ও মানিয়ে চলার সমস্যায় (অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার) আক্রান্ত হতে পারে, যা তাদের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেয় ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।

সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এসব রোগীকে অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে হূদরোগ বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি নিয়মিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হচ্ছে। হূদরোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় কেবল খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ব্যায়াম আর ওষুধ সেবনই যথেষ্ট নয়; জীবনযাত্রার পরিবর্তন, আচরণের পরিবর্তন এবং সঠিক মানসিক সাম্যাবস্থাও প্রতিরোধ করতে পারে জীবনবিনাশী হূদরোগ। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে সবাইকে।

সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট-২০০৯