মো. তারিকুল ইসলাম রেডিওলজি ও ইমেজিং বিশেষজ্ঞ
এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট
গর্ভস্থ শিশু বিভিন্নভাবে তেজস্ক্রিয় রশ্মির সংস্পর্শে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত গর্ভস্থ শিশুর মা তেজস্ক্রিয় রশ্মির সংস্পর্শে আসেন এবং এরই একাংশ গর্ভস্থ শিশুর কাছে পৌঁছে যেতে পারে। আবার গর্ভবতী মা অনেক সময় চিকিৎসাগত কারণে তেজস্ক্রিয় পদার্থযুক্ত ওষুধ খেয়ে থাকেন, যা মায়ের মূত্রাশয়ের দেয়ালে অনেক দিন জমা থাকে এবং মূত্রাশয়ের পেছনে অবস্থিত জরায়ু ও ভ্রূণের ওপর তেজস্ক্রিয় রশ্মি ছড়িয়ে দিতে পারে।
সারা বিশ্বেই মানুষ প্রতিনিয়ত অল্পমাত্রায় তেজস্ক্রিয় রশ্মির সম্মুখীন হচ্ছে। একে বলা হয় প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা। এর উৎস হচ্ছে প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ, বিভিন্ন মহাজাগতিক রশ্মি, যা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে চলে আসে। প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা অল্প মাত্রায় বিরাজ করে, তবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা যত বেশি হয়, এর মাত্রা ততই বাড়তে থাকে।
তেজস্ক্রিয় রশ্মির কার্যকর মাত্রার একককে বলা হয় মিলি সিভার্ট। সাধারণভাবে একজন মানুষ বছরে তিন মিলি সিভার্ট প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হয়। তিন মিলি সিভার্ট তেজস্ক্রিয়তা মা ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে অনেক কম। প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা ছাড়াও একজন গর্ভবতী মা তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা পদার্থের সম্মুখীন হতে পারে−এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, ফ্লুরোস্কোপি (বিশেষ ধরনের এক্স-রে) পরীক্ষা করালে, ক্যানসার চিকিৎসার জন্য রেডিওথেরাপি গ্রহণ করলে কিংবা তেজস্ক্রিয় পদার্থযুক্ত ওষুধ গ্রহণ করলে।
একজন গর্ভবতী মা বেশি মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হলে তাঁর গর্ভস্থ ভ্রূণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সে জন্য গর্ভবতী মায়েদের এ ধরনের পরীক্ষা করাতে বা চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
সাধারণভাবে বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার যে মাত্রা ব্যবহার করা হয়, তা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার তুলনায় অনেক বেশি। একবার বুকের এক্স-রে করালে একটা মানুষ যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসে, তা প্রায় ১০ দিনের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমান, যার কার্যকর মাত্রা প্রায় ০.১ মিলি সিভার্ট। কিডনি ও মূত্রাশয় পরীক্ষার জন্য আইভিপি বা ইন্টর্্রাভেনাস পাইলোগ্রাম পরীক্ষায় ব্যবহূত তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ এক বছরের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমান।
পেটের সিটিস্ক্যান, খাদ্যনালির সিটিস্ক্যান (সিটি কোলোনোগ্রাফি) ও খাদ্যনালির এক্স-রেতে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয়, তা প্রায় তিন বছরের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমমাত্রার। একজন মানুষ মাথার সিটিস্ক্যান করালে যে মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হন, তা প্রায় আট মাসের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমান। আবার বুকের সিটিস্ক্যান কিংবা মেরুদণ্ডের সিটিস্ক্যানে ব্যবহূত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা প্রায় দুই বছরের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার সমমাত্রার।
আশার কথা হলো, রোগ নির্ণয়ে ব্যবহূত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি এটা ঠিক, কিন্তু ভ্রূণের বা গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হওয়ার জন্য যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তার প্রয়োজন, তার তুলনায় অনেক কম। গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষতি হওয়ার জন্য সাধারণভাবে ২০০ মিলি সিভার্ট তেজস্ক্রিয়তার প্রয়োজন। তবে ভ্রূণের বয়স দুই সপ্তাহের কম হলে ৫০ মিলি সিভার্ট তেজস্ক্রিয়তায় গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মা বুঝতেই পারেন না যে তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন। রোগ নির্ণয়ের জন্য যে পরীক্ষাগুলো করা হয়, এর মাত্রা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ১০ মিলি সিভার্টের চেয়ে কম হয়। সে ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় রশ্মি দিয়ে এই পরীক্ষাগুলো সাধারণভাবে নিরাপদ। আবার একজন গর্ভবতী মা তেজস্ক্রিয় রশ্মি দিয়ে পরীক্ষা করালেই যে তা ভ্রূণের কাছে পৌঁছে যাবে, তা নয়। তেজস্ক্রিয় রশ্মি সরল পথে চলাচল করে, কাজেই জরায়ু ও এর আশপাশের অঙ্গের পরীক্ষা করালেই কেবল ভ্রূণ প্রত্যক্ষ তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হয়। দূরবর্তী অঙ্গের পরীক্ষা করালে কিছু বিক্ষিপ্ত রশ্মি ভ্রূণ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, তবে এর মাত্রা অনেক কম।
যেসব অঙ্গের পরীক্ষায় সরাসরি ভ্রূণে তেজস্ক্রিয়তা পৌঁছার সম্ভাবনা রয়েছে, এর মধ্যে আছে মেরুদণ্ডের নিচের অংশের এক্স-রে বা সিটিস্ক্যান, কিডনি ও মূত্রাশয় দেখার জন্য আইভিপি, জরায়ুর গঠন দেখার জন্য এক্স-রে হিস্টেরোসালফিঙ্গোগ্রাম, তলপেট বা হিপ-জয়েন্টের পরীক্ষা, ক্ষুদ্রান্ত ও বৃহদন্ত্রের পরীক্ষা ইত্যাদি।
তবে রোগ নির্ণয় ছাড়াও চিকিৎসার জন্য তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহূত হতে পারে। সাধারণত ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া থাইরয়েডের ক্যান্সার বা হাইপার থাইরোয়েডিজমের জন্য তেজস্ক্রিয় পদার্থযুক্ত ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এ ক্ষেত্রে বেশি হতে পারে কিংবা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, যা ভ্রূণের জন্য ক্ষতিকর।
গর্ভস্থ শিশুর ওপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব তার বয়স, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ও তেজস্ক্রিয়তার সময়ের ওপর নির্ভর করে। গর্ভস্থ শিশু যত কম বয়সে তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হয়, তেজস্ক্রিয়তার সংবেদনশীলতা তত বেশি থাকে; অর্থাৎ ক্ষতির আশঙ্কা, ব্যাপকতা বেশি থাকে; আবার তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এবং বেশি সময় ধরে এর কার্যকারিতা থাকলে স্বভাবতই ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।
গর্ভস্থ শিশু তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হলে তার জন্ন-পরবর্তী ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং এ ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ও সময় যত বাড়বে, ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তত বাড়বে।
গর্ভধারণে সক্ষম যেকোনো নারীর চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তাঁর চিকিৎসককে জানানো প্রয়োজন যে তিনি গর্ভবতী কি না অথবা গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক প্রথমে গর্ভধারণের ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন। তারপর রোগীর চিকিৎসাপত্র দেবেন। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক গর্ভবতী মা ও ভ্রূণের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ এবং তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার আছে, এমন পরীক্ষা ও ওষুধ যথাসম্ভব বাদ দেবেন।
অনেক সময় দেখা যায়, একজন মহিলা এক্স-রে, সিটিস্ক্যান ইত্যাদি পরীক্ষা করার পর বুঝতে পারেন, তিনি ওই পরীক্ষা করার সময় গর্ভবতী ছিলেন। এ ক্ষেত্রে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কারণ রোগ নির্ণয়ে ব্যবহূত তেজস্ক্রিয় রশ্মির পরিমাণ অনেক কম থাকে, ফলে ক্ষতির ঝুঁকিও কম। আবার জরায়ুর দূরবর্তী অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোর পরীক্ষায় (যেমন−মায়ের মাথা, হাত, পা, বুকের পরীক্ষা) ভ্রূণের ওপর প্রত্যক্ষ তেজস্ক্রিয় রশ্মি পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে অতি অল্প মাত্রায় কিছু বিক্ষিপ্ত রশ্মি ভ্রূণের সংস্পর্শে আসতে পারে এবং ক্ষতির আশঙ্কাও খুব কম।
যেসব ক্ষেত্রে ভ্রূণের ওপর সরাসরি তেজস্ক্রিয় রশ্মি পড়ার ঝুঁকি আছে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে বিকল্প পরীক্ষা বা চিকিৎসার চেষ্টা করা উচিত।
জরায়ুর বাইরের বিভিন্ন
অঙ্গ-প্রতঙ্গের পরীক্ষার ক্ষেত্রে পেটের ওপর তেজস্ক্রিয়তা প্রতিরোধক পর্দা (লেড অ্যাপ্রোন) রাখার জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বা কর্তব্যরত যিনি আছেন তাঁকে অনুরোধ করুন।
গর্ভবতী অবস্থায় বিমান ভ্রমণ: দূরপাল্লার বিমানগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচু দিয়ে যাতায়াত করে। ভূপৃষ্ঠ থেকে যত ওপরে যাওয়া যায় ততই প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। অল্প সময়ের জন্য অনিয়মিত বিমান ভ্রমণে গর্ভবতী মা বা ভ্রূণের ক্ষতির আশঙ্কা বেশ কম। তবে যাঁরা ঘন ঘন দূরপাল্লার বিমানে ভ্রমণ করে থাকেন, তাঁদের নিজেদের ওপর তেজস্ক্রিয়তার মাত্রার হিসাব রাখা প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত সফটওয়্যারের সাহায্য নিতে হবে এবং প্রাপ্ত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অনুসারে কার্যতালিকায় পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন, রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ গ্রহণ, সব ক্ষেত্রেই কিছু ক্ষতি আর কিছু উপকারী দিক আছে।
উপকারের পাল্লা ভারী হলে তখনই কেবল নির্দিষ্ট পরীক্ষা করানো হয় এবং চিকিৎসাপত্র দেওয়া হয়। তেজস্ক্রিয়তারও কিছু ক্ষতিকর দিক আছে, তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে এবং সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করলে এর থেকে আমরা সর্বোচ্চ উপকার পেতে পারি।
সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট-২০০৯